বর্তমানে ক্রিকেট বিশ্বে লেগ স্পিনারদের রাজত্ব। তবে এই দারুণ শিল্প যে ক’জন আয়ত্ব করতে পেরেছেন তাদের মাঝে সেরাদের সেরা কেবলই একজন। তিনি লেগ স্পিনের রাজা শেন ওয়ার্ন। যিনি লেগ স্পিনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। লেগস্পিনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তার সময়ে ক্রিকেট বিশ্বে পেসারদের রাজত্ব ছিলো। এমন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের মতো আবির্ভাব শেন ওয়ার্নের। শতাব্দীর সেরা স্পিন বলটাও আসে তার হাত ধরেই।
পুরো নাম শেন কেইথ ওয়ার্ন। অনেকে তাকে ভালোবেসে ওয়ার্নি বলে ডাকতেন। ১৯৬৯ সালের আজকের দিনে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের ভিক্টোরিয়ার ফার্নট্রি গুল্লি এলাকায়, কেইথ এবং ব্রিডজেটের ঘরে জন্মেছিলেন শতাব্দীর সেরা এই স্পিনার। লেগ স্পিনের পাশাপাশি অফস্পিনটাও করতোন সমান তালে। এছাড়াও কখনো কখনো ব্যাট হাতে লো-অর্ডারে নেমে খেলেগেছেন সাবলীলভাবে।
ছোট বয়সেই স্কুল ক্রিকেটে বৃত্তি পেয়েছিলেন ওয়ার্ন। ক্রিকেটে শুরুটা হয় ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে ভার্সিটিতে পড়াকালীন ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। ১৬ বছর বয়সে তৎকালীন ভিক্টোরিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অনূর্ধ্ব-১৬ ডাউলিং শিল্ড প্রতিযোগিতায় খেলেন। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলও খেলেছেন সিন্ট কিল্ডা দলের হয়ে। স্বপ্ন ছিল অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল স্টার হওয়া। ১৯৮৭ সালে সেন্ট কিল্ডা দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়ান নিয়ম অনুসারে ফুটবলে যোগ দেন। ক্রিকেটের অফ সীজনে অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ফুটবল খেলেন সেন্ট কিলডা ক্লাবের হয়ে। ফুটবল ছেড়ে পরবর্তীতে সম্পূর্ণভাবে ক্রিকেটের দিকে মনোযোগ দেন।
১৯৯০ সালে অ্যাডিলেডে অজি ক্রিকেট একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য সুযোগ পান। পরের বছরে ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে ইংলিশ ক্লাব অ্যাক্রিংটন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে পেশাদার ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয়। সেখানে এক মৌসুম খেলার পর পরের মৌসুমে বাদ পড়েন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মেলবোর্নের জংশন ওভালে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভিক্টোরিয়ার হয়ে অভিষিক্ত হন ওয়ার্ন। শুরুটা খুব একটা দুর্দান্ত ছিলোনা যদিও। একই বছরে অস্ট্রেলিয়া বি দলের হয়ে জিম্বাবুয়ে সফরে যান। ঐ সফরে হারারে স্পোর্টস ক্লাবে অস্ট্রেলিয়া বি দলের হয়ে এক ইনিংসে ৫ উইকেটের বেশি উইকেট নিয়ে নিজের জাত চিনিয়ে দেন ওয়ার্ন। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কেবল ছুটেছেন নিজস্ব গতিতে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন ১৯৯২ সালের ২ রা জানুয়ারীতে ভারতের বিপক্ষে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। অস্ট্রেলিয়ার ৩৫০ তম টেস্ট ক্যাপ তার মাথায় পড়িয়ে দেওয়া হয়। এর আগে শেন ওয়ার্ন মোটামুটি ক্রিকেট বিশ্বে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বল করতে নামার পরেই রবি শাস্ত্রী রীতিমতো তাকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন। সেবার খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি৷ ১৫০ রান খরচায় মাত্র ১টি উইকেট এসেছিল। শুরুটা দুর্দান্ত না হলেও ধীরে ধীরে ওয়ার্ন তার লেগ স্পিনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। হয়েছেন সেরাদের সেরা। ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে কিউইদের বিপক্ষে তার এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়। এরপর কেবল ছুটেছেন।
১৯৯৩ সাল ওয়ার্নকে নিয়ে য়ায় অনন্য উচ্চতায়। সেই বছরেই তৎকালীন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা একজন তারকা মাইক গ্যাটিংকে দুর্দান্ত স্পিন ঘূর্ণিতে আউট করেন। যা শতাব্দীর সেরা বল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এটি ছিলো অ্যাশেজে করা ওয়ার্নের প্রথম বল। সেবার অস্ট্রেলিয়ার ২৮৯ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমেছিল ইংলিশরা। ৭১ রানের মাথায় উদ্বোধনী জুটি ভেঙে গেলে ক্রিজে আসেন মাইক গ্যাটিং। স্পিনের বিরুদ্ধে ইংলিশদের এই তুরুপের তাস হয়তো কল্পনাই করতে পারেননি একটু পর কি ঘটতে যাচ্ছে। ২৪ বছর বয়সী ওয়ার্নের বলের ঘূর্ণির গতিটাকেই উল্টো পড়ে ফেলেছিলেন তিনি। খেলতে চেয়েছিলেন ধীরে-সুস্থে। কিন্তু মুহূর্তেই যেন বলের ঘূর্ণির মোড় ঘুরে গেলো অন্য দিকে। অবিশ্বাস্য এক ডেলিভারিতে অফ স্ট্যাম্পে বোল্ড আউট হলেন গ্যাটিং। অবাক বিস্ময়ে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন ২২ গজে। সে ম্যাচে ম্যাচসেরার পুরষ্কার আসে ওয়ার্নের হাতে। আর তার করা সেই দুর্দান্ত ডেলিভারি ঠাঁই পায় শতাব্দীর সেরা ডেলিভারি হিসেবে। সেদিন মূলত ক্রিকেট বিশ্বে স্পিনারদের রাজত্বের জানান দেন ওয়ার্ন।
১৯৯২ সালে সিডনিতে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে ২০০৭ সালে সেই সিডনিতেই শেষ টেস্ট খেলে বর্ণাঢ্য টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ওয়ার্ন। এর মাঝে কেবল সৃষ্টি করে গেছেন দুর্দান্ত সব ইতিহাস।
টেস্টঃ ১৪৫ টেস্টে ২৭৩ ইনিংসে ৪০৭০৫ টি বল করে ১৭৯৯৫ টি রান খরচায় ২৫.৪১ গড়ে নিয়েছেন ৭০৮ টি উইকেট। তাঁর ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ বোলিং ফিগার ১ ইনিংসে ৭১ রান খরচায় ৮ উইকেট। এছাড়াও ১ ম্যাচে নিয়েছেন ১২৮ রান খরচায় ১২ উইকেট। ক্যারিয়ারে ১০টি করে উইকেট নিয়েছেন ১০ বার, ৫টি করে উইকেট নিয়েছেন ৩৭ বার, ৪টি করে উইকেট নিয়েছেন ৪৮ বার। জেনুইন লেগ স্পিনার হিসেবে পরিচিত হলেও ব্যাট হাতেও লো-অর্ডারে খেলে গেছেন সাবলীলভাবে। ১৪৫ ম্যাচে ১৯৯ ইনিংসে ব্যাট হাতে ৫৪৭০ বল মোকাবেলা করে ১৭.৩২ গড়ে করেছেন ৩১৫৪ রান। কোন শতক না থাকলেও এই ফরম্যাটে তাঁর ১২ টি পঞ্চাশের ইনিংস রয়েছে। ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ ৯৯ রানের ইনিংস খেলেছেন।
১৯৯৩ সালে এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু। সেই থেকে থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ওয়ানডে খেলেছেন ওয়ার্ন। ওয়ানডেতে ১৯৪ ম্যাচে ১৯১ ইনিংসে ১০৬৪২ বল করে ৭৫৪১ রান খরচায় ২৫.৭৩ গড়ে ও ৪.২৫ ইকনোমিতে নিয়েছেন ২৯৩ উইকেট। এই ফরম্যাটে তাঁর সর্বোচ্চ বোলিং ফিগার ছিল ৩৩ রান খরচায় ৫ উইকেট। ৫ উইকেট নিয়েছেন ১ বার, এবং ৪ উইকেট নিয়েছেন ১২ বার। ১৯৪ ম্যাচে ব্যাট করার সুযোগ পান ১০৭ ম্যাচে। ১০৭ টি ম্যাচে ১৪১৩ বল মোকাবেলা করে নিয়েছেন ১০১৮ রান। ওয়ানডেতে ফিফটির ইনিংস খেলেছেন একবার।
সব মিলিয়ে উপমহাদেশের স্পিন সহায়ক পিচের বাইরেই নিয়েছেন শুধু ৫৭৫ উইকেট। আন্তর্জাতিকে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টি-২০ খেলেন নি তবে বিগ ব্যাশ ও আইপিএলে টি-২০ খেলেছেন। ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে আইপিএল খেলেছেন। মেন্টরেড ভূমিকায়ও ছিলেন। তার অধিনায়কত্বে রাজস্থান আইপিএল ট্রফি জিতেছিল। ২০১৩ সালে বিগ ব্যাশে শেষ টি-২০ ম্যাচ খেলে সবরকমের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। একই বছরে তিনি আইসিসির ক্রিকেট হল অব ফ্রেমে স্থান পান।
দীর্ঘ ১৬ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে রয়েছে নানাবিধ অর্জন। যা তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। এর মধ্যে অন্যতমঃ ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের অন্যতম সদস্য, ৬০০ ও ৭০০ উইকেট নেয়া ১ম বোলার, সেমিফাইনাল এবং ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়, অ্যাশেজে করা ১ম বল শতাব্দীর সেরা বলের স্বীকৃতি, ১৯৯৪ সালে উইজডনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতি লাভ, ১৯৯৭ সালে জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্তি, ২০০৪ সালে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ উইকেট লাভ।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে নানাবিধ অর্জনের পাশাপাশি বিতর্কেরও শেষ ছিলোনা। বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ কারণে বিতর্কিত হয়েছেন ওয়ার্ন। ২০০৩ বিশ্বকাপের আগে ডোপ টেস্ট পজেটিভ হওয়ায় দলের বাইরে ছিলেন। পরবর্তীতে আবারো আবির্ভূত হন স্বমহিমায়। দ্যুতি ছড়িয়েছেন দুর্দান্ত স্পিনে।
কিংবদন্তি এই স্পিন জাদুঘর ২০২২ সালের মার্চ মাসে থাইল্যান্ডে অবকাশযাপনকালে হৃৎযন্ত্র বন্ধ হওয়ায় এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
ক্রিকেট বিশ্বে অনেক স্পিনার জন্ম নিলেও আজীবন ওয়ার্ন রইবেন বিশ্ব সেরার ভূমিকায়। নতুন স্পিনারদের স্বপ্নের তারকা হয়ে রইবেন স্মৃটিপটে। ক্রিকেট বিশ্ব আজীবন ওয়ার্নের বীরত্বেগাঁথা গাইবেন তরুণ স্পিনারদের সামনে। বিশ্বসেরাদের খেতাব অনেকেই পাবেন, কিন্তু রাজা হিসেবে কেবল ওয়ার্নই রইবেন সবার শীর্ষে। সবার স্মৃতিপটে অমর হয়ে রইবেন ‘কিং অব স্পিন’ হিসেবে।